Dhaka 10:35 am, Friday, 18 July 2025

জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ রাকিবের মানবেতর জীবন-যাপন

বৈসম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে রাকিব। গুলি রাকিবের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। সবাই ভেবেছিলো রাকিব মারা গেছে। তারপরেও কয়েকজনে ধরে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাড়িতে মা-বাবা সহ সবাই জানে রাকিব পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। বাড়িতে কান্নার রোল পরে যায়। রাকিবের পরিবারের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এরই মাঝে খবর আসে রাকিব বেঁচে আছে, স্থানীয়দের সহায়তায় একটি এম্বুল্যান্সে ভাড়া করে রওনা হয় রাকিবের মা-বাবা ছেলেকে দেখার জন্য। বর্তমানে গুলিবিদ্ধ রাকিব মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জুলাই বিপ্লবে গুলি লেগে আহত আহত মো. রাকিব মোল্যা (২৪), ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের চরবাংরাইল মোল্যা পাড়া এলাকার ভ্যান চালক মো. হান্নান মোল্যার বড় ছেলে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রাকিব পরিবারের অর্থের যোগান দাতা। জীবিকার জন্য সাত বছর আগে ঢাকায় পারি জমান তিনি। কাজ করেন একটি মটরসাইকেল গ্যারেজে। সেখানে যা বেতন পান নিজের জন্য কিছু রেখে সব পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। সেখানে পরিবারের ভরনপোষণ ও ছোট ভাইদের লেখাপড়ার খরচ চলে। রাকিবরা পাঁচ ভাই এক বোন। দরিদ্র হলেও রাকিব মেধাবী, যদিও অর্থের অভাবে লেখাপড়া করতে পারেন বেশি দুর।

গুলিবিদ্ধ রাকিব মোল্যা জানান, ঢাকার যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকায় থাকেন তিনি, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুপুত্রকে দেখতে বাড়িতে এসেছিলেন। নয় দিনের ছোট্ট ছেলেকে বাড়িতে রেখে দুদিন পর কাজের জন্য আবারও ঢাকায় ফেরেন। কারফিউতে দুদিন আটকা থাকেন বাসায়, এরপর টিভিতে আন্দোলনের খবর দেখে ২০ জুলাই তিনিও যোগ দেন ছাত্র-জনতার সাথে। ঐ সময় রাকিব ব্রীজের ঢালে অবস্থান করছিলেন। হটাৎ একটি বুলেট এসে রাকিবের বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠের বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাকিব, পাশে থাকা ব্যাক্তিরা রাকিব কে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুপুর দেড়টার দিকে গুলি লাগলেও হাসপাতালে ভর্তি করতে অনেক সময় লাগে।

বিকেল পাঁচটার পর রাকিব কে ঢাকা মেডিকেলে ভতি করানো হয়। সেখানে আইসিইউতে রাখা হয়, এরপর পর্যায়ক্রমে কিছুটা সুস্থ হন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন টি অপারেশন হয় রাকিবের, সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৯ আগষ্ট-২৪ তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকার বর্ডার গার্ড হাসপাতালে। সেখানে দুটি অপারেশনের পর দীর্ঘ পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে ৯ জানুয়ারি-২০২৫ গ্রামের বাড়িতে আসেন রাকিব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিজিবি হাসপাতালে উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই দেখতে যান। খোঁজ খবর নেন, তখন অনেকেই সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিলে পরে আর কেউ খোজ খবর নেয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের তালিকাভুক্ত করার জন্য কয়েকদফা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন রাকিব।

ঢাকায় এক ব্যবস্থা হলেও গ্রামের বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছে রাকিব। কোন কাজ করতে পারেন না, হাত দিয়ে ভারি কিছু তুললে মনে হয় বুকের ভেতর থেকে নাড়িভুড়ি ছিড়ে যাচ্ছে। ৯ দিন রেখে যাও শিশুপুত্র রাফসান মোল্যার বয়স এখন আট মাস। বাচ্চার খাবার ও রাকিবের ঔষধ কিনতে এবং সংসারের খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ভ্যান চালক বাবার। স্থানীয়রা খোঁজ খবর নিলেও তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে না। আহত রাকিব তার শিশু পুত্রকেও কোলে নিতে পারে না। তারপরেও মায়া করে মাঝে মধ্যে কোলে নিলে বুকের ভেতর ব্যাথা করে। আকাশের দিকে হাহাকার করে রাকিব বলেন, বাবা হয়েছি কিন্তু বাবার কোন কর্তব্য পালন করতে পারি নাই। এক সময়ে পরিবারের হাল ধরলেও এখন পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেছি।

স্থানীয়রা জানান, রাকিবরা পাঁচ ভাই, জায়গা জমি বলতে কিছুই নেই। মাত্র তিন শতক জমি সবাই মিলে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেখানে ঘর তুলে থাকে রাকিবের পরিবার। তার বাবা একজন ভ্যান চালক। ঢাকায় রাকিবের মৃত্যুর খবরে পরিবারের আর্তনাদ দেখে আমরা চাদা তুলে একটি এম্বুল্যান্স ভাড়া করে দিলে রাকিব কে দেখতে যায় তার মা বাবা। কিন্তু মহান আল্লাহ রাকিব কে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ছোট্ট মাসুম বাচ্চার দিকে তাকালে অনেক কষ্ট হয়। রাকিবকে যে ঔষধ কিনে দিবে বা ওর বাচ্চার জন্য খাবার কিনে দিবে এমন পরিস্থিতি নাই বললেই চলে। রাকিবের চিকিৎসার খরচ যোগাতে প্রায় সব কিছুই শেষ ওর পরিবারের। দেশবাসিসহ সকলের কাছে রাকিব ও তার পরিবারের জন্য আমরা দোয়া চাই।

এই বিষয়ে সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ইতোপূর্বে জুলাই আন্দোলনে আহত নিহতদের তালিকা যাচাই বাছাই করা হয়েছে। সে তথ্য প্রমান সহ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারে। যাচাই বাছাই তালিকায় তার নাম আসলে আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বরেন্দ্র সচেতন সমাজ’র উদ্যোগে মাসব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন

জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ রাকিবের মানবেতর জীবন-যাপন

Update Time : 08:26:00 pm, Wednesday, 5 March 2025

বৈসম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে রাকিব। গুলি রাকিবের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। সবাই ভেবেছিলো রাকিব মারা গেছে। তারপরেও কয়েকজনে ধরে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাড়িতে মা-বাবা সহ সবাই জানে রাকিব পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। বাড়িতে কান্নার রোল পরে যায়। রাকিবের পরিবারের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এরই মাঝে খবর আসে রাকিব বেঁচে আছে, স্থানীয়দের সহায়তায় একটি এম্বুল্যান্সে ভাড়া করে রওনা হয় রাকিবের মা-বাবা ছেলেকে দেখার জন্য। বর্তমানে গুলিবিদ্ধ রাকিব মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জুলাই বিপ্লবে গুলি লেগে আহত আহত মো. রাকিব মোল্যা (২৪), ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের চরবাংরাইল মোল্যা পাড়া এলাকার ভ্যান চালক মো. হান্নান মোল্যার বড় ছেলে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রাকিব পরিবারের অর্থের যোগান দাতা। জীবিকার জন্য সাত বছর আগে ঢাকায় পারি জমান তিনি। কাজ করেন একটি মটরসাইকেল গ্যারেজে। সেখানে যা বেতন পান নিজের জন্য কিছু রেখে সব পাঠিয়ে দেন বাড়িতে। সেখানে পরিবারের ভরনপোষণ ও ছোট ভাইদের লেখাপড়ার খরচ চলে। রাকিবরা পাঁচ ভাই এক বোন। দরিদ্র হলেও রাকিব মেধাবী, যদিও অর্থের অভাবে লেখাপড়া করতে পারেন বেশি দুর।

গুলিবিদ্ধ রাকিব মোল্যা জানান, ঢাকার যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকায় থাকেন তিনি, সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুপুত্রকে দেখতে বাড়িতে এসেছিলেন। নয় দিনের ছোট্ট ছেলেকে বাড়িতে রেখে দুদিন পর কাজের জন্য আবারও ঢাকায় ফেরেন। কারফিউতে দুদিন আটকা থাকেন বাসায়, এরপর টিভিতে আন্দোলনের খবর দেখে ২০ জুলাই তিনিও যোগ দেন ছাত্র-জনতার সাথে। ঐ সময় রাকিব ব্রীজের ঢালে অবস্থান করছিলেন। হটাৎ একটি বুলেট এসে রাকিবের বুকের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠের বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাকিব, পাশে থাকা ব্যাক্তিরা রাকিব কে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুপুর দেড়টার দিকে গুলি লাগলেও হাসপাতালে ভর্তি করতে অনেক সময় লাগে।

বিকেল পাঁচটার পর রাকিব কে ঢাকা মেডিকেলে ভতি করানো হয়। সেখানে আইসিইউতে রাখা হয়, এরপর পর্যায়ক্রমে কিছুটা সুস্থ হন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন টি অপারেশন হয় রাকিবের, সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৯ আগষ্ট-২৪ তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকার বর্ডার গার্ড হাসপাতালে। সেখানে দুটি অপারেশনের পর দীর্ঘ পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে ৯ জানুয়ারি-২০২৫ গ্রামের বাড়িতে আসেন রাকিব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিজিবি হাসপাতালে উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই দেখতে যান। খোঁজ খবর নেন, তখন অনেকেই সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিলে পরে আর কেউ খোজ খবর নেয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের তালিকাভুক্ত করার জন্য কয়েকদফা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন রাকিব।

ঢাকায় এক ব্যবস্থা হলেও গ্রামের বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছে রাকিব। কোন কাজ করতে পারেন না, হাত দিয়ে ভারি কিছু তুললে মনে হয় বুকের ভেতর থেকে নাড়িভুড়ি ছিড়ে যাচ্ছে। ৯ দিন রেখে যাও শিশুপুত্র রাফসান মোল্যার বয়স এখন আট মাস। বাচ্চার খাবার ও রাকিবের ঔষধ কিনতে এবং সংসারের খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ভ্যান চালক বাবার। স্থানীয়রা খোঁজ খবর নিলেও তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে না। আহত রাকিব তার শিশু পুত্রকেও কোলে নিতে পারে না। তারপরেও মায়া করে মাঝে মধ্যে কোলে নিলে বুকের ভেতর ব্যাথা করে। আকাশের দিকে হাহাকার করে রাকিব বলেন, বাবা হয়েছি কিন্তু বাবার কোন কর্তব্য পালন করতে পারি নাই। এক সময়ে পরিবারের হাল ধরলেও এখন পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেছি।

স্থানীয়রা জানান, রাকিবরা পাঁচ ভাই, জায়গা জমি বলতে কিছুই নেই। মাত্র তিন শতক জমি সবাই মিলে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেখানে ঘর তুলে থাকে রাকিবের পরিবার। তার বাবা একজন ভ্যান চালক। ঢাকায় রাকিবের মৃত্যুর খবরে পরিবারের আর্তনাদ দেখে আমরা চাদা তুলে একটি এম্বুল্যান্স ভাড়া করে দিলে রাকিব কে দেখতে যায় তার মা বাবা। কিন্তু মহান আল্লাহ রাকিব কে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ছোট্ট মাসুম বাচ্চার দিকে তাকালে অনেক কষ্ট হয়। রাকিবকে যে ঔষধ কিনে দিবে বা ওর বাচ্চার জন্য খাবার কিনে দিবে এমন পরিস্থিতি নাই বললেই চলে। রাকিবের চিকিৎসার খরচ যোগাতে প্রায় সব কিছুই শেষ ওর পরিবারের। দেশবাসিসহ সকলের কাছে রাকিব ও তার পরিবারের জন্য আমরা দোয়া চাই।

এই বিষয়ে সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ইতোপূর্বে জুলাই আন্দোলনে আহত নিহতদের তালিকা যাচাই বাছাই করা হয়েছে। সে তথ্য প্রমান সহ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারে। যাচাই বাছাই তালিকায় তার নাম আসলে আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।