Dhaka 9:52 am, Friday, 18 July 2025

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে উজিরপুরের মৃৎশিল্প

বাঙালির শত বছরেরর পুরনো ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। একেকটি শিল্প বিস্তারের পেছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। যারা মাটি নিয়ে কাজ করে পেশায় তারা কুমার বা পাল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাতে তারা পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারপরও দেশে এমন এলাকা বা গ্রাম আছে যেখানে এখনো বাংলার ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী। এ কারণে চাহিদা কম, কাঁচামালের সংকট ও চড়ামূল্য, সর্বোপরি পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে উজিরপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।

উপজেলা ও পৌর সদরের ৮ নং ওয়ার্ডের মাহার গ্রামের মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকা পাল বংশের লোকেরা। এখানে বসবাসকারী ৮-১০ টি পরিবারের মানুষ এই পেশার সাথে জড়িত। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম হলেও কর্মঠ মানুষের সংখ্যাই বেশি। ঐ পাড়ার সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখা গেল প্রায় ঘরগুলো মাটি, ও টিনশেড দিয়ে তৈরি। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠান। উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাদামাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, কলস, হাতি, ঘোড়া, মাছ পুতুলসহ ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র।
তাদের শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। আধুনিকতার প্রবল স্রোতে বাংলার প্রাচীন এই শিল্পের সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে বহু বছর ধরে জড়িত থাকা মানুষগুলো। বর্তমান সভ্যতার সাথে পেরে উঠছে না এই মাটির কারিগররা। আগে বিভিন্ন মাটির তৈরি দ্রব্যাদি ব্যবহার হলেও মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এসব সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

কুমারবাড়ীর বাসিন্দা কালাচাঁদ পাল জানান, ব্যবসা মন্দার কারণে আমাদের এখাকার মৃৎশিল্প প্রস্তুতকারী বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। সামান্য আয়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে বলে অভিযোগ করেন এই কুমার। ব্যবসা না থাকায় অনেকে এখন অন্য কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। কাজেই এ মৃৎশিল্প ধরে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বাড়িতে ঢুকলে চোখে পড়বে মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমের জিনিস। কোনোগুলো কাঁচা, আবার কিছু শুকিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু পুড়িয়ে রং করেও বিক্রির জন্য তৈরি করা হচ্ছে। তার স্ত্রী বলেন, মাটির এসব কাজ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের কয়েক পুরুষ ধরে এ কাজ করে আসছে। আমরাও করছি। মাঠ থেকে মাটি এনে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করে আমরা জীবিকা চালাই। কয়েকজন মৃৎশিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, আমরা আর এই সব কাজ করতে পারছি না। মেলামাইন, সিরামিক ও প্লাস্টিকের কারণে আমরা তাদের সাথে খরচ আর তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। যদি আমাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ আর সহজ ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমরা মনে হয় কিছুটা হলেও এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারব। মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন উপজেলার কুমারবাড়ীর কুমাররা।

মৃৎশিল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলী সুজা বলেন, ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আমাদের আদি সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার এগিয়ে আসা উচিৎ। মৃৎশিল্প আধুনিকায়ন করতে আমরা সরজমিনে তথ্য নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বরেন্দ্র সচেতন সমাজ’র উদ্যোগে মাসব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে উজিরপুরের মৃৎশিল্প

Update Time : 04:52:16 pm, Monday, 12 May 2025

বাঙালির শত বছরেরর পুরনো ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। একেকটি শিল্প বিস্তারের পেছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। যারা মাটি নিয়ে কাজ করে পেশায় তারা কুমার বা পাল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাতে তারা পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তারপরও দেশে এমন এলাকা বা গ্রাম আছে যেখানে এখনো বাংলার ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তনের ফলে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি নানা রকম আধুনিক সামগ্রী। এ কারণে চাহিদা কম, কাঁচামালের সংকট ও চড়ামূল্য, সর্বোপরি পুঁজির অভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে উজিরপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।

উপজেলা ও পৌর সদরের ৮ নং ওয়ার্ডের মাহার গ্রামের মৃৎশিল্পীদের ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকা পাল বংশের লোকেরা। এখানে বসবাসকারী ৮-১০ টি পরিবারের মানুষ এই পেশার সাথে জড়িত। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম হলেও কর্মঠ মানুষের সংখ্যাই বেশি। ঐ পাড়ার সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখা গেল প্রায় ঘরগুলো মাটি, ও টিনশেড দিয়ে তৈরি। বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠান। উঠানজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাদামাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, কলস, হাতি, ঘোড়া, মাছ পুতুলসহ ছোট-বড় নানা রকমের পাত্র।
তাদের শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। আধুনিকতার প্রবল স্রোতে বাংলার প্রাচীন এই শিল্পের সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে বহু বছর ধরে জড়িত থাকা মানুষগুলো। বর্তমান সভ্যতার সাথে পেরে উঠছে না এই মাটির কারিগররা। আগে বিভিন্ন মাটির তৈরি দ্রব্যাদি ব্যবহার হলেও মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এসব সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

কুমারবাড়ীর বাসিন্দা কালাচাঁদ পাল জানান, ব্যবসা মন্দার কারণে আমাদের এখাকার মৃৎশিল্প প্রস্তুতকারী বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। সামান্য আয়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে বলে অভিযোগ করেন এই কুমার। ব্যবসা না থাকায় অনেকে এখন অন্য কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। কাজেই এ মৃৎশিল্প ধরে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বাড়িতে ঢুকলে চোখে পড়বে মাটির তৈরি বিভিন্ন রকমের জিনিস। কোনোগুলো কাঁচা, আবার কিছু শুকিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু পুড়িয়ে রং করেও বিক্রির জন্য তৈরি করা হচ্ছে। তার স্ত্রী বলেন, মাটির এসব কাজ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের কয়েক পুরুষ ধরে এ কাজ করে আসছে। আমরাও করছি। মাঠ থেকে মাটি এনে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করে আমরা জীবিকা চালাই। কয়েকজন মৃৎশিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, আমরা আর এই সব কাজ করতে পারছি না। মেলামাইন, সিরামিক ও প্লাস্টিকের কারণে আমরা তাদের সাথে খরচ আর তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। যদি আমাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ আর সহজ ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমরা মনে হয় কিছুটা হলেও এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারব। মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন উপজেলার কুমারবাড়ীর কুমাররা।

মৃৎশিল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলী সুজা বলেন, ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আমাদের আদি সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার এগিয়ে আসা উচিৎ। মৃৎশিল্প আধুনিকায়ন করতে আমরা সরজমিনে তথ্য নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।